হলুদ-নীল স্বপ্নমায়া

ভালবাসি তোমায় (ফেব্রুয়ারী ২০১৪)

আশরাফুল ইসলাম
যোগাযোগটা আমাদের ফোনে, ফোনেই পরিচয়। তন্দ্রা’র সযত্নে গুছিয়ে বলা সুন্দর কথার আবেশ আমাকে মোহাবিষ্ট করে। রবী ঠাকুর, জীবনানন্দ কিংবা নির্মলেন্দু গুণ-এর আবৃত্তি তন্দ্রার কণ্ঠে শুনে আমি হারিয়ে যাই কবিতার প্রাণময় জগতে। তন্দ্রা জানায়, অনেক দিন সে কোন আবৃত্তি করে নি। এখন করছে শুধু আমার জন্যে। বলে, এমন মুগ্ধ শ্রোতা পেলে আমৃত্যু আবৃত্তি চালিয়ে যেতেও আমার কোন দ্বিধা নেই।
আমি বলি, জন্মের অপর পিঠে যেমন মৃত্যু আছে। ভালবাসার অপর পিঠেও তো বিচ্ছেদ নামে একটি শব্দ রয়েছে। তাকে কি আমরা জয় করতে পারবো?
-শেষ আছে জেনে কি মানুষ কোন কিছু শুরু করে? জন্মের আয়োজনে যেমন আমরা মুখর হই, তেমনি ভালবাসার সুর বাজাতেও তো আমরা নানা আয়োজনে জীবন মন্দিরা ভরিয়ে রাখি।
তন্দ্রার অসাধারণ কথার জাদুর নিকট এক সময় আমাকে হার মানতেই হয়। পেশাগত জীবনের দুর্দান্ত লেকচারার, বিতর্ক সভা বা আড্ডার প্রাণবন্ত বিতার্কিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অনর্গল মৃদুভাষী এই আমি তন্দ্রার সঙ্গে কথা বলতে যেয়ে কেবলই খেই হারিয়ে ফেলি। কোন কিছু বলতে গিয়ে কেমন যেন গুলিয়ে ফেলি। যে কারণেই আমি ওর সঙ্গে কথা বলার সময় নিজে তেমন একটা বলি না, কেবল শুনেই যাই। নিজের এ অক্ষমতা ঢাকতে তন্দ্রার নিকট থেকে ওর ডাক যোগাযোগের ঠিকানাটা চেয়ে নেই চিঠি লিখবো বলে।
কিন্তু, লিখতে বসে বুঝতে পারি, কি অকর্মটাই না করেছি। কি লিখবো, কি লিখবো না- করে করে একটা দিন পার। লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ফোনের ওপাশ থেকে তাগাদা আসে, কি খবর- চিঠি লিখেছো?
আমি উত্তর দেই- লিখি নি, তবে লিখবো।
মনে মনে ভাবি, কি লিখবো! কোনদিন কোন নারীকে উদ্দেশ্য করে তো কিছু লিখি নি। পরদিন অভিধানের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে একটি খসড়া দাঁড় করাই। একটু ঘষামাজা করে চিঠিটি খামবন্ধ করি। খামের উপর ওর ঠিকানা লিখতে গিয়ে কিছুটা হোঁচট খাই। যে ঠিকানাটা ও দিয়েছে সেখানে তো একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাস করার কথা। তারপরও বিষয়টাকে সাত-পাঁচ ভেবে আমলে না নিয়ে চিঠিটি ডাকে দেই।
চিঠিটি ডাকে দেয়ার পর দুশ্চিন্তাটা মাথায় চেপে বসে। চিঠিটি পড়ে তন্দ্রার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
কলেজে একটা ক্লাস নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই মোবাইলটি বেজে ওঠে। ক্লাস রুমের বাইরে এসে ফোনটা রিসিভ করি। আশ্চর্য একটা ভালোলাগা হঠাৎ ছুঁয়ে যায় আমাকে। তন্দ্রার ফোন! জানায়, আমার চিঠি সে পেয়েছে। চিঠির লেখাগুলো নাকি ওর অসম্ভব ভালো লেগেছে।
মুহূর্তে আমার সব ভীরুতা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, আমি সাহস ফিরে পাই। বুদ্ধি করে ওর সঙ্গে একটা সন্ধি করি, এখন থেকে আমাদের যোগাযোগ হবে কেবলই চিঠিতে। ওকে তাগাদা দেই, খুব তাড়াতাড়ি যেন ওর চিঠিটা ডাকে দেয়। তারপরও আমি তন্দ্রার সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারি না। সব কিছু কেমন যেন বিষণ্ণ ঠেকে।
প্রতিদিন ডাকঘরে খবর নেই- ওর কোন চিঠি এলো কিনা। প্রতিবারই পিয়নের হাসিমুখের নিরস উত্তরটি আমাকে হজম করতে হয়।
প্রতিদিনকার মতো অফিসে কর্মব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। পিয়ন এসে হাতে একটি হলুদ খাম ধরিয়ে দেয়। খামটি উল্টিয়ে প্রেরকের নামে চোখ বুলাতেই চোখ দু’টো সেখানে আটকে যায়। নিজেকে হঠাৎ অচেনা মনে হয়। গাম্ভীর্যটা হারিয়ে ফেলি মুহূর্তেই। লটারিতে লাখ টাকা পাওয়ার মতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভুলে যাই স্থান-কাল-পাত্রের কথা। অপরিণত কিশোরের মতো খামটি খুলে চোখের সামনে মেলে ধরি তন্দ্রার সুনিপুণ হস্তাক্ষরমালা। চিঠি পড়ে বুঝতে পারি, ব্যক্ত কথার ভিড়েও অব্যক্ততার বিমূর্ত পৃথিবীতে অনুভবের এক আদিগন্ত রহস্যের দরজা আমার সামনে মেলে ধরেছে সে।
তারপর থেকে একের পর এক চিঠি আর ফোনালাপে সারল্য আর মুগ্ধতার এক অনুপম পৃথিবীতে ক্রমশই দু’জনে অবগাহন করি। পরিচয় আর ঘনিষ্ঠতার এক পর্যায়ে জানতে পারি, আমার আর তন্দ্রার মধ্যে ধর্মের ভিন্নতা রয়েছে। হঠাৎ করে মনটা ভারাক্রান্ত হয়। তন্দ্রাকে দোষ দিতে গিয়ে নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত হই। আমার ভেতরের বিনাশী কালো অন্ধকার যে নক্ষত্রের আলোর অনুভবে এমন নিপুণ হয়ে ওঠেছে, যার জোছনার প্রবাহিত নদী আমাকে সুখের নিমগ্ন স্রোতে এমন উচ্ছল করেছে, তাকে কি করে ভুলে যাই বা কষ্ট দেই! থাকুক না ধর্ম নামের এক অনাকাঙ্ক্ষিত দেয়াল, তাকে কি ভালবাসার অমৃত আবরণে মোড়ানো যায় না!
তন্দ্রার সঙ্গেও কথা হয় অকপটে। বেশ বুঝতে পারি, অসম ধর্মের দেয়ালকে ভেদ করে সে আমার আলোর নক্ষত্র হবার বাসনাই পোষণ করে। আমি আত্মবিশ্বাসী হই। সে আত্মবিশ্বাস ও তন্দ্রার হৃদয় সুষমায় জীবনের ক্যানভাসে ভালবাসার তুলিতে এক অনুপম রেখাচিত্র ফুটিয়ে তুলতে উদ্যমী হই।
একদিন সুদূর চাটগাঁও থেকে তন্দ্রার আন্তরিক আহ্বান আসে। তন্দ্রার জন্মদিনের অনুষ্ঠান। আমাকে যেতেই হবে। তন্দ্রার এমন আন্তরিকতাপূর্ণ ডাক আমি উপেক্ষা করতে পারি না। তন্দ্রাকে এই প্রথম বাস্তবে দেখতে পাব, তার সঙ্গে সরাসরি বাক্য বিনিময় হবে- ভাবতেই যে পুলক জাগে!
নৌকা-বাস-ট্রেন জার্নি করে এক সুন্দর শীতের সকালে হাজির হই তন্দ্রার ঠিকানায়। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা রিং দেই তন্দ্রার মোবাইলে। তন্দ্রা জানায়, সে এখনই আসছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি গেট খোলার অপেক্ষায়। কিন্তু গেট খোলার নামটি পর্যন্ত নেই।
অকস্মাৎ আমার সামনে এসে ব্রেক কষে একটি লেটেস্ট মডেলের মারুতি। দেখি, গাড়ির দরজা ঠেলে নামছেন এক সুদর্শন যুবক সঙ্গে এক তরুণী। তরুণীটির দিকে এক পলক তাকাতেই বুঝলাম, এ-ই তন্দ্রা; আমার স্বপ্নচারিনী-আঁধার মানবী-আলোর নক্ষত্র। বাস্তবের তন্দ্রা ছবি আর কল্পনার তন্দ্রার চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর আর ইমপ্রেসিভ।
আমি আর নিজের উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারি নি। বলেই ফেলি, হাই তন্দ্রা! কেমন আছ তুমি?
-ভাল, তারপর তুমি কেমন আছ ধ্রুব?
অসম্ভব রকমের ভাল, বলে যুবকের দিকে তাকিয়ে বলি- উনি?
-এসো তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে আমার ফোন এন্ড পেন ফ্রেন্ড ধ্রুব। আর ধ্রুব ও হচ্ছে আমার হবু বর অর্ণব। কানাডায় থাকে। কালকে আমার বার্থডে পার্টিতে আমাদের এনগেজমেন্ট হবে।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠি আমি। একি বলছে তন্দ্রা! কেবল তার আহ্বানেই সহস্র মাইল পেছনে ফেলে ছুটে এসেছি সুদূর চাঁটগায়। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি নি। তারপরও অর্ণবের দিকে হাত বাড়িয়ে দেই নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে। মনের ভেতর একটা খচখচানি হয়, তন্দ্রা আমার সঙ্গে ফান করছে নাতো! কেননা, আমি ওর এই ¯^ভাবটির সঙ্গে খুব বেশি পরিচিত। আমি অশ্বত্থ হওয়ার ভঙ্গিতে বলি, তুমি কি আমার সঙ্গে ফান করছো?
-না, ধ্রæব। ফান করবো কেন, সিরিয়াসলি বলছি। আর এই বাসাটা যে ঠিকানায় তুমি চিঠি লিখতে আমার এক বান্ধবীর। ভেতরে চলো, ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো।
পা দু’টো নিশ্চল হয়ে আসে। এখানে এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করে না। নিজেকে প্রকৃতিস্থ করে একটি অজুহাত দাঁড় করিয়ে ওদের নিকট থেকে বিদায় নেই।
রিকশাটা চলতে শুরু করতেই তন্দ্রার পরিচিত সেই হাসির শব্দ শুনতে পাই। অনিচ্ছায় হলেও পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, তন্দ্রা ও অর্ণব হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসে। কতো কাছের মানুষকেই অনেক সময় অচেনা মনে হয়, এমন কি রক্ত সম্পর্কের আপনজনদেরও। আর তন্দ্রা.....।
একটা নীল কষ্ট এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়। কখন যে দু’চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু জড়ো হয়েছে বুঝতে পারি নি। রুমালের খুঁটে চোখ মুছে রিকশা থেকে নেমে এগোতে থাকি রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারের দিকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
হাবিব রহমান ৭০-৮০ দশকের প্রেমকাহিনীর মতই কিন্তু বর্তামানের সাথে জুৎসই মিলেমিশে একাকার। ভাল লাগল।
ভালো লাগেনি ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪
তাপসকিরণ রায় গল্পটি আমার বেশ ভাল লেগেছে। সুন্দর ভাব ভাষার প্রয়োগ,গল্পের ধারাবহটাও বেশ টিকালো।
ভালো লাগেনি ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪
ওয়াহিদ মামুন লাভলু একটা নীল কষ্ট এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়। কখন যে দু’চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু জড়ো হয়েছে বুঝতে পারি নি। ভালবাসা থেকে উদ্ভুত গভীর বেদনার গল্প। চমৎকার লিখেছেন। শ্রদ্ধা জানবেন।
ভালো লাগেনি ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

০২ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪